ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের লক্ষণ কী?
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই প্রচলিত একটি সমস্যা। এই সংক্রমণ বারবার হতে থাকলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে।এ নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। বর্তমানে তিনি ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই বিষয়টি কী?
উত্তর : ইউরেটার, মূত্রথলি, প্রস্রাব যে নালি দিয়ে বেরিয়ে আসে, মূত্রনালি—এসব অংশের ভেতর যদি জীবাণু কোনোভাবে ঢুকে যায়, আর সেই সমস্যা যদি বাড়তে থাকে, একে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বলা হয়। মূলত এতে প্রদাহ হয়, সংক্রমণজনিত সমস্যা এটি। জীবাণুগুলো জায়গাটিতে আক্রমণ করে, প্রদাহ হয়, ক্ষত সৃষ্টি করে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
প্রশ্ন : এ ধরনের সংক্রমণে কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
উত্তর : সাধারণত নারীরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে পুরুষরাও আক্রান্ত হতে পারে বিশেষ বিশেষ অবস্থায়। তরুণরা কিন্তু এখানে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। নারীদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ হলো এদের মূত্রনালি জন্মগতভাবেই পুরুষদের চেয়ে ছোট এবং সেটি পায়ুপথের খুব কাছাকাছি থাকে। তাই দেখা গেছে, যে জীবাণু দিয়ে এই মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয়, তার ৯৫ শতাংশই আসে মলদ্বার থেকে এবং মলের সঙ্গে যে জীবাণুগুলো আসে, সেখান থেকে আক্রান্ত হয়। তাই দুটি কাছাকাছি থাকায় সহজে জীবাণুগুলো মূত্রনালিতে চলে আসে এবং সেখান থেকে ওপরের দিকে গিয়ে মূত্রথলি ও কিডনি আক্রান্ত করে বসতে পারে। রোগটি নারীদের বেশি হয়।
এ ছাড়া প্রস্রাব কিডনি থেকে যে চলে আসে, এই আসার পথে যদি কোনো কারণে বাধার সৃষ্টি হয়, কোনো কারণে, সেটা পাথর দিয়ে হতে পারে, নালির যেকোনো জায়গায় সরু হতে পারে। প্রস্রাব যখন করতে থাকে, সেখানে বাধা হতে থাকে। বয়স্ক পুরুষদের যদি প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যায়, তাদের প্রস্রাব প্রবাহ বাধা থেকে বেড়ে বেড়ে সংক্রমণ হয়।
আবার নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেকের জরায়ুটা নিচে নেমে আসে। তাদের সংক্রমণ বেশি হয়। সহবাসের পরও অনেক সময় এই সমস্যা হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যারা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খাচ্ছে, যেমন ক্যানসারের ওষুধ বা অন্য কোনো স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ খাচ্ছে, এদের যেহেতু প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, এদেরও সংক্রমণ হওয়ার হার বেশি। এ ছাড়া যারা পানি কম পান করে, যারা প্রস্রাবের চাপ হলে ধরে রাখে, বিশেষ করে যেসব মা-বোন অফিসে চাকরি করে, তারা হয়তো টয়লেটে যেতে লজ্জাবোধ করে, অথবা পরিবেশ থাকে না টয়লেটে যাওয়ার, কিংবা শহরে জীবনযাপনে রাস্তাঘাটে বের হলে, সে রকম সুযোগ-সুবিধাও পায় না, সে জন্য চেপে রাখে—তাদের হয়।
আবার বাচ্চারা অনেক সময়, স্কুলে গিয়ে স্কুলের অপরিচ্ছন্ন টয়লেটে যেতে পছন্দ করে না, প্রস্রাব ধরে রাখে, এ জন্য অনেক সময় বাচ্চাদের সংক্রমণ হয়। এসব অনেক কারণে সংক্রমণ হতে পারে।
প্রশ্ন : ইউটিআই সংক্রমণে শরীরে কী ধরনের সমস্যা হয়?
উত্তর : আসলে এর সমস্যাগুলো অনেক কষ্টদায়ক। তারা যে অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে, সেগুলো হলো প্রস্রাব ঘন ঘন হচ্ছে, প্রস্রাব করার পরও মনে হবে প্রস্রাব রয়ে গেল। এসেই আবার তাদের বার বার বাথরুমে যেতে হচ্ছে। প্রস্রাব করার সময় প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া হয়। আবার দেখা যায়, তাদের তলপেটে ব্যথা হচ্ছে। আর জীবাণুগুলো যদি একদম ওপরে ওঠে, কিডনি পর্যন্ত চলে আসে, তখন কোমরের দুই পাশে ব্যথা, সেই সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর হতে পারে।
আর অনেক সময় বয়স্ক লোকেরা বোঝে না যে তাদের সংক্রমণ হয়েছে। এদের দেখা যায় যে বিছানায় শুয়ে আছে, কথাবার্তা হয়তো স্বাভাবিক বলত, তবে একসময় তাদের বোধশক্তি কাজ করছে না।
আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যারা খুব ছোট বাচ্চা, এরাও জ্বালাপোড়ার কথা বলতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে, ওজন কমে যাচ্ছে। কারো দেখা যায় ডায়রিয়া হচ্ছে, খুব অল্প অল্প জ্বর হচ্ছ। তবে কাশি নেই। অথচ তাদের জ্বর থাকছে। এ রকম অস্বাভাবিক কোনো সংক্রমণ থাকলেও ধরে নিতে হবে প্রস্রাবের সংক্রমণের জন্য সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : ইউটিআইর চিকিৎসা না করা হলে এবং বারবার হতে থাকলে কী কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : যারা প্রবীণ বয়সে আছে বা ছোট বাচ্চা, যারা নিজেদের কষ্টগুলো বোঝাতে পারে না, এদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এই জীবাণুগুলো হয়তো বারবার আক্রমণ হয়। জীবাণুগুলো প্রথমে মূত্রতন্ত্রে থাকে। এর পর রক্তে ছড়িয়ে যায়। রক্তে ছড়িয়ে গেলে একে বলে সেপটিসেমিয়া। যদি বারবার আক্রমণ হতে থাকে, দেখা যায়, জীবাণুগুলো সেপটিসেমিক শকে চলে যায়। এত জীবাণু ছড়িয়ে যায় যে রক্তচাপ কমে যায়। আইসিইউতে গিয়ে দেখবেন, অনেক রোগী সেপটিসেমিক শক নিয়ে, কিডনির অকার্যকরিতা নিয়ে, মরণাপন্ন অবস্থায় আমাদের কাছে আসে।
আরেকটি হতে পারে গর্ভাবস্থায়। গর্ভাবস্থায় যদি তাদের সংক্রমণ হয়, আর এর যদি চিকিৎসা না হয়, একদিকে মায়ের যেমন ক্ষতি হতে পারে, গর্ভজাত সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার মৃত্যু হতে পারে। কাজেই বারবার ইউটিআই হলে অনেক ক্ষতি হতে পারে। এটি বারবার হতে থাকলে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।